কক্সবাজারে ৯৮টি ঘুষের লেনদেন মামলায় ধীরগতি

২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার (এলএ) জরিপকারক বা সার্ভেয়ার ওয়াসিম উদ্দিন খান, ফরিদ উদ্দিন ও মো. ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ‘ঘুষে’র ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও সাত বস্তা ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত নথিপত্র।

আড়াই বছর পর এসে জানা যাচ্ছে, এ ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই।

শুরু থেকে মামলাটির তদন্ত করছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। তিনি তদন্ত করতে গিয়ে কক্সবাজারের সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বিজয় কুমার সিংহসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেন। মামলায় পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে এলএ শাখার ৯৮টি লেনদেনে ঘুষের তথ্য উঠে আসে।

দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির আরও কিছু অভিযোগ তদন্ত করছিলেন। পরে তাঁকে প্রথমে বদলি করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে করা হয় চাকরিচ্যুত। ওদিকে ৯৮ লাখ টাকা উদ্ধারের ওই মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ জনের ১২ জনই জামিনে বেরিয়ে গেছেন।

বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন দুদক কক্সবাজার জেলার সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত চলছে। নতুন করে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

শুধু এই মামলা নয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়ম ও এলএ শাখার কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দুর্নীতির মামলার বিচারকাজে অগ্রগতি কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় পরও তদন্তই শেষ হয়নি। কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমানকে শুক্রবার ২৩ লাখ টাকাসহ ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর নতুন করে ঘুষ–দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। আতিকুরের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা করেছে দুদক।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারে সরকারের প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার ৭২টি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এর আগে দুদকের তিনটি তদন্তে ভূমি অধিগ্রহণে মোট ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে।

কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে হওয়া দুর্নীতির মামলাগুলোর বিচার হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে। সেখানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের এলএ শাখায় দুর্নীতিসংক্রান্ত বিচারাধীন মামলা ৩২টি। আর তদন্তাধীন রয়েছে ২৬টি।

তদন্তাধীন মামলাগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন দুদক চট্টগ্রামের পরিচালক মাহমুদ হাসান ও দুদক কক্সবাজারের উপপরিচালক মঈনুল ইসলাম।

২০১৯ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রাম এলএ শাখার চেইনম্যান নজরুল ও অফিস সহকারী তছলিম উদ্দিনকে ৯১ লাখ টাকার চেক, নগদ সাড়ে ৭ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে তদন্ত করতে গিয়ে নজরুল ও তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে প্রায় ৩ কোটি ১৪ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য পায় দুদক, যা ‘অবৈধভাবে’ অর্জিত। এই ঘটনায় নজরুল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়।

দুদক বলছে, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে নজরুল মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী পলাতক। আড়াই বছরেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

মামলাটি তদন্ত করছেন দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক আতিকুল আলম। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত চলছে।

২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর দুদক ঘুষের ২ লাখ ১০ হাজার টাকাসহ কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কানুনগো আবদুর রহমানকে নিজের অফিস থেকেই গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় গত বছরের মে মাসে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর শুধু তারিখ পড়ছে, সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে না। আগামী ২৫ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।

২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে ইলিয়াস ভুঁইয়া নামের এক দালালের ব্যাগ থেকে ৫৮ লাখ টাকা উদ্ধার হয়। পরে তদন্তে উঠে আসে যে টাকাগুলো নিয়ে আদালত ভবনে এলএ শাখার সার্ভেয়ার শহীদুল ইসলামের কাছে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্ত ইলিয়াসকে টাকাগুলো কে দিয়েছিলেন, সেটি তদন্তে উঠে আসেনি। শুধু সার্ভেয়ার শহীদুল ও ইলিয়াসকে মামলায় আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলাটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন।

সাক্ষ্য শুরু হতে দেরি কেন, জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রামের আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, ‘সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় দেরি হচ্ছে। আগামী ধার্য দিনে আশা করি হাজির করা যাবে।’

দোহাজারী ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প, গ্যাসলাইন প্রকল্প,চট্টগ্রামে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি প্রকল্পগুলোতে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে জমির মালিকদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়।

এই টাকার ভাগ পান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পসহ তিনটি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে দুদক ঘুষের তথ্য–প্রমাণ পায়। দুদকের তদন্তে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী, দালাল এবং জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় আড়াই শ জনের জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। যদিও দুদকের চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক শরীফ তদন্ত শেষ করার আগেই বদলি ও চাকরিচ্যুত হন।

ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তারের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলোর তদন্তে বিলম্ব ও বিচার শেষ না হওয়ায় দুর্নীতিবাজেরা উৎসাহিত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী।

তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির পেছনে বড় কর্তা যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বড় কর্তার ইশারা ছাড়া এভাবে ঘুষের লেনদেন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এসব দুর্নীতবাজের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে। নইলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে।

প্রসঙ্গত,কক্সবাজারে গভীর সমুদ্র বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, জ্বালানি পাইপলাইন প্রকল্প, পিবিআইয়ের দপ্তর, বিমানবন্দর ছাড়াও গড়ে উঠছে টুরিস্ট জোন। সব মিলিয়ে ৭০টির মতো প্রকল্পে প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে কক্সবাজার জেলা জুড়ে। অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার একর জমি। জমি অধিগ্রহণের (এলএ) ক্ষতিপূরণের কমিশন ব্যবসার দালালিতে জড়িয়ে পড়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী, সাংবাদিক ছাড়াও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাও।

সূত্র : প্রথম আলো